মাদ্রিদ বিমান বন্দরের মাটিতে পা রাখতেই গোটা শরীরে একটা শিহরণ খেলে গেল আহমদ মুসার। সে শিহরণের মধ্যে একটা গৌরবও আছে, কিন্তু বেদনার ভাবটাই মুখ্য। সাতশ’ এগারো খৃষ্টাব্দে তারিক বিন যিয়াদ এমনি করেই স্পেনের এক প্রান্ত জাবলুত তারিকে পা রেখেছিলেন। তার সেদিনের অনুভূতি ছিল বিজেতার, এই আইবেরীয়া উপদ্বীপের মানুষকে মুক্ত করার এবং তাদেরকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে আসার আনন্দও ছিল তার অন্তরে। কিন্তু আজ স্পেনের মাটির স্পর্শ থেকে সৃষ্ট শিহরণ আহমদ মুসার হৃদয়টাকে যেন বেদনায় মুষড়ে দিল! দূরে সরে যাওয়া, পর হয়ে যাওয়া আত্মীয়ের মুখোমুখি হওয়ার মতোই যেন ব্যাপারটা। আহমদ মুসার মনে হলো স্পেনের মাটিই যেন তাকে বিস্ময়ের সাথে চোখ তুলে দেখছে! তার চোখেও যেন অতীতের বেদনার এক অনুরণন। অনাকাঙ্ক্ষিত দখলের অধীন কেউ যেমন হঠাৎ দেখা পাওয়া মুক্ত আপনজনের প্রতি বিস্ময় আর বেদনার আকুতি নিয়ে তাকায় এ যেন ঠিক তেমনি! আহমদ মুসার মনে হলো, স্পেনের বোবা এই দৃষ্টিতে এক সাগর কথা যেন উপচে পড়ছে। যেন বলছে, অযোগ্য, অপদার্থ তোমরা পালিয়ে গেছ আমাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করে, আজ অমন বেদনা নিয়ে তাকচ্ছ কেন?
স্পেনের মাটিতে পা রেখে আবেগে, আবেশে আহমদ মুসা হঠাৎ করে চলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিল। তার চোখের দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে উঠেছিল। কিন্তু পেছনে তখন যাত্রীর স্রোত। কে একজন পেছন থেকে তার পায়ে হোঁচট খেয়ে ‘স্যরি’ বলে উঠল। সম্বিত ফিরে পেল আহমদ মুসা। হাঁটতে শুরু করল। কিন্তু পায়ে যেন জোর পাচ্ছে না সে। হঠাৎ কেমন এক অবসাদ এসে তাকে ঘিরে ধরেছে! স্পেনের বেদনাময় অতীত যেন সবটাই এসে তার মাথায় চেপে বসেছে। দেহের প্রতিটি রক্ত কণিকায় তা ছড়িয়ে দিয়েছে অবসাদজনক এক যন্ত্রণা।
আহমদ মুসা লাগেজের অপেক্ষায় বসে ছিল। বসে বসে সে মাদ্রিদের ট্যুরিষ্ট গাইডের ওপর নজর বুলাচ্ছিল।
পাশের চেয়ারে একজন তরুনী এসে বসল। স্প্যানিশ। পরনে প্যান্ট, গায়ে শার্ট। চেহারায় নরম লাবণ্য। কিন্তু চোখে মুখে ভাব-ভংগিতে বুদ্ধি ও শক্তি যেন ঠিকরে পড়ছে!
তরুণীটি বলল, ‘মাফ করবেন, আপনি কি অধূমপায়ী?’
তরুণীটি হাতে সিগারেটের একটি প্যাকেট ও একটি লাইটার।
‘হ্যাঁ, অধূমপায়ী।’ ট্যুরিষ্ট গাইড থেকে মুখ তুলে বলল আহমদ মুসা। ‘তবে আপনি ধুমপান করতে পারেন।’
‘থ্যাংক ইউ।’ সিগারেটের প্যাকেট ও লাইটার পকেটে রাখতে রাখতে বলল মেয়েটি।
‘বললাম তো আমার অসুবিধা নেই।’
মেয়েটির দিকে পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে মুখে সামান্য হাসি টেনে বলল আহমদ মুসা।
‘থ্যাংক ইউ।‘ সংক্ষিপ্ত উত্তর মেয়েটির।
আহমদ মুসা আবার মনোযোগ দিল ট্যুরিষ্ট গাইডের দিকে। কিছুক্ষণ পর গাইডটি উল্টে পাল্টে বন্ধ করল। তারপর তরুণীর দিকে মুখ ঘুরিয়ে একটু দ্বিধা করে বলল, ‘মাফ করবেন, মাদ্রিদে কি মুসলিম হোটেল আছে?’
মেয়েটি চোখ তুলে মুহুর্তকাল আহমদ মুসার দিকে চেয়ে রইল। তার চোখে কৌতুহল। বলল সে, ‘আপনি নিশ্চয় মুসলমান?’
‘হ্যাঁ।’ বলল আহমদ মুসা।
‘নিশ্চয় স্পেনেও নতুন?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তবু স্পেনের কথা তো আপনার জানার কথা?’
‘তা ঠিক, কিছু জানি কিন্তু সব জানি না।’
‘স্পেনে মুসলিম পরিচয় নিয়ে কোন হোটেলে ওঠা সম্ভব নয়, এটা তো সবার জানা কথা।’
‘দুঃখিত, আমি এতটা জানি না।’
‘আপনার দেশ কোথায়?’
দ্বিধায় পড়ল আহমদ মুসা। কোনটাকে তার দেশ বলবে? সে তো যাযাবর। বিভিন্ন দেশ থেকে পাসপোর্ট নিয়েছে। অবশেষে বলল, ‘আমি যুগোশস্নাভিয়া থেকে আসছি।’
মেয়েটির মুখে ছোট্ট একটা হাসি ফুটে উঠল। বলল, ‘যুগোশস্নাভিয়া থেকে স্পেন তো বেশি দূরে নয়?’
‘আমার মাতৃভুমি আরো দূরে, মধ্যএশিয়া।’
’বুঝলাম।’
লাগেজ আসতে শুরু করেছে।
‘মাফ করবেন।’ বলে আহমদ মুসা উঠে দাঁড়াল।
মেয়েটির প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচল। মেয়েটির প্রশ্নের হাত থেকে বাঁচতে পেরে খুশিই হলো আহমদ মুসা। কি করি, সংঘাতকালীন যুগোশস্নাভিয়া কেন গিয়েছিলাম, স্পেনে কেন এসেছি? এমন সব প্রশ্নেও সে করতে পারত।
আহমদ মুসা লাউঞ্জ থেকে কারপার্কে বেরিয়ে এসেছে। সে এক ড্রাইভারের সাথে কথা বলছে। আহমদ মুসা আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্কসমৃদ্ধ শেরাটন হোটেলে ওঠাই ঠিক করেছে। এসব হোটেলে হালাল খাদ্যের ব্যাস্থা থাকে।
The author saimumseries has offered the item for free, you can now download it.
DownloadPublished:
05 December, 2024
Category: